শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২৪ অপরাহ্ন

র‍্যাবের হেফাজতে নারীর মৃত্যু: কোনও দাবি নেই পরিবারের, করবে না মামলাও

র‍্যাবের হেফাজতে নারীর মৃত্যু: কোনও দাবি নেই পরিবারের, করবে না মামলাও

নওগাঁ প্রতিনিধি

নওগাঁয় র‌্যাব হেফাজতে অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে মারা যাওয়া সুলতানা জেসমিনের (৪০) বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রতারণার মামলা করায় বিস্মিত হয়েছেন তার স্বজন ও সহকর্মীরা। বিস্ময় প্রকাশ করলেও তাদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই ঘটনায় তাদের কোনও দাবি নেই এবং মামলাও করবেন না।

গত বুধবার (২২ মার্চ) নওগাঁ সদরের চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী জেসমিনকে র‌্যাব আটকের পরদিন রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাটি করেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এনামুল হক।

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, চাঁদপুর জেলার হাইমচর থানার গাজী বাড়ি এলাকার বাসিন্দা আল আমিন ও নওগাঁর সুলতানা জেসমিনসহ অজ্ঞাত দুই-তিন জন ব্যক্তি যুগ্ম সচিব এনামুল হকের নাম ও পদবী ব্যবহার করে ফেসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন লোকজনকে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

তবে জেসমিনের বিরুদ্ধে ওঠা এমন অভিযোগ বিশ্বাস করতে পারছে না তার স্বজন, প্রতিবেশী ও সহকর্মীরা। সুলতানা জেসমিনের মামা ও নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু বলেন, ‘আমার ভাগ্নি অত্যন্ত সাদামাটা। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ছোট্ট একটা চাকরি করে ছেলেটাকে মানুষ করছে সে। তার ছেলের লেখাপড়ার খরচের টাকা অনেক সময় আমাকে দিতে হয়। আর্থিক অনিয়ম করলে তো অভাব-অনটন থাকতো না। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমার ভাগ্নি একটা চক্রান্তের শিকার হয়েছে। আমার বিশ্বাস, সঠিকভাবে তদন্ত করলে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হবে।’

সুলতানা জেসমিনের একমাত্র সন্তান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শাহেদ হোসেন সৈকত এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা বলছেন না।

জেসমিনের ভাই সোহাগ মিয়া বলেন, ‘আমার বোনের সঙ্গে যা ঘটেছে এটা সবাই জানে। আর কোনও কথা বলতে চাই না। মামলাও করতে চাই না। আমাদের কোনও দাবি নেই।’

নওগাঁ সদরের চন্ডিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অফিস সহায়ক পদে চাকরিরত ছিলেন জেসমিন। গত আট বছর ধরে শহরের জনকল্যাণপাড়ার দেলোয়ার হোসেন দুলালের বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেছিলেন। প্রায় ১৭ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ছিল তার সংসার। ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

সুলতানা জেসমিনের যে বাসায় ভাড়া থাকতেন তার মালিক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘জেসমিন দীর্ঘদিন ধরে তার বাসায় ভাড়া থাকলেও তার কোনও অস্বাভাবিক চলাফেরা কখনও চোখে পড়েনি। তার মতো মহিলা অন্যের ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে চাকরি দেওয়ার নাম করে মানুষকে প্রতারণা করবে এটা বিস্ময়কর।’

কী ঘটেছিল…

স্বজনদের দাবি, বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সুলতানা জেসমিন অফিসে যাওয়ার পথে র‍্যাব সদস্যরা রাস্তা থেকে তাকে মাইক্রোবাসে করে ধরে নিয়ে যায়। র‍্যাবের দাবি, তার বিরুদ্ধে আরেকজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তার নামে টাকা চাওয়া বা চাকরি দেওয়ার নামে বহু মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দিলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। তবে আটক হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

র‍্যাব বলছে, নওগাঁয় র‍্যাবের কোনও ক্যাম্প না থাকায় তাকে আটক করার পর পাশের জয়পুরহাট ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নওগাঁ সদর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এ বিষয়ে র‍্যাব-৫ এর অধিনায়ক রিয়াজ শাহরিয়ার গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, ‘যে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতারণার অর্থ লেনদেন হতো সেটির সূত্র ধরে সুলতানা জেসমিনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আসে। ক্যাম্প যেহেতু দূরে, তাই আটকের পর গাড়ির ভেতরেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন র‍্যাব সদস্যরা তার মোবাইল নিয়ে লক খুলতে বললে তিনি ভীষণ ঘাবড়ে যান, ঘামতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি পাসওয়ার্ড দিলে আমরা অভিযোগের কিছু সত্যতা পাই। এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেই তিনি বমি করতে শুরু করেন। তখন আমরা তাকে দ্রুত নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই।’

নওগাঁ হাসপাতালে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন থাকার পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাজশাহীতে নেওয়ার পর তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে তিনি মারা যান। সকালে তার মৃত্যু হলেও স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয় শনিবার বিকালে। শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের বুঝিয়ে দেয় র‍্যাব।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |